প্রারম্ভিক আলোচনা: অধ্যায়টা গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যায় সারবস্তু:
১. ক্ষরণ পদ্ধতি ও গ্রন্থিতে নালীর উপস্থিতির ভিত্তিতে গ্রন্থিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
· বহিঃক্ষরা গ্রন্থি
· অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি
২. বহিঃক্ষরা গ্রন্থি: যে সব গ্রন্থি নালীযুক্ত অর্থাৎ গ্রন্থি নিঃসৃত রস নির্দিষ্ট গ্রন্থিনালী দিয়ে নিকটেই কোন ক্রিয়াস্থলে পৌছায়, এমন গ্রন্থিকে বহিঃক্ষরা গ্রন্থি বলে। যেমন: লালাগ্রন্থি, যকৃত, ঘামগ্রন্থি ইত্যাদি। বহিঃক্ষরা গ্রন্থি এনজাইম নিঃসরণ করে।
৩. অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি: যে সব গ্রন্থি নালীবিহীন অর্থাৎ গ্রন্থি নিঃসৃত রস ক্ষরিত হয়ে রক্তে যায়, এবং রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে ক্রিয়াস্থলে পৌছায়, এমন গ্রন্থিকে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি বলে। যেমন: পিটুইটারী গ্রন্থি, থাইরয়েড গ্রন্থি, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ইত্যাদি। অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হরমোন নিঃসরণ করে।
৪. কিছু গ্রন্থি আছে যা এনজাইম ও হরমোন, দু’টিই নিঃসরণ করে, এদের মিশ্রগ্রন্থি বলা হয়। যেমন: অগ্ন্যাশয়, শুক্রাশয়, ডিম্বাশয় ইত্যাদি।
(বহিঃক্ষরা বলতে এমন মনে হতে পারে যে বাইরে বা অনেক দূরে ক্ষরণ করছে, আর অন্তঃক্ষরা বলতে কাছেই ক্ষরণ করছে। ব্যাপারটা এভাবে দেখতে হবে যে, গ্রন্থি থেকে বাইরে গ্রন্থিনালী দিয়ে গিয়ে লক্ষ্যে পৌছায়, আর অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির রস রক্তে মিশে গিয়ে অন্তঃস্থ ভাবে সারা দেহেই অবস্থান করে)
৫. বহিঃক্ষরা গ্রন্থির মধ্যে প্রধান তিনটি হচ্ছে:
· লালাগ্রন্থি = লালারস ক্ষরণ করে
· যকৃত = পিত্তরস ক্ষরণ করে (পিত্তথলী ক্ষরণ করে না, বরং সংরক্ষণ করে)
· অগ্ন্যাশয় = অগ্ন্যাশয় রস ক্ষরণ করে
অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি:
৬. পিটুইটারী গ্রন্থি: (Master বা প্রধান গ্রন্থি):
অঞ্চল |
নিঃসৃত হরমোন |
হরমোনের কাজ |
অগ্রবর্তী অঞ্চল
|
সোমাটোট্রফিক বা বৃদ্ধিবর্ধক হরমোন |
মানুষের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ করে
|
থাইরয়েড উত্তেজক (স্টিমুলেটিং) হরমোন |
থাইরয়েড গ্রন্থির ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ |
|
অ্যাড্রিনোকর্টিকোট্রফিন হরমোন
|
অ্যার্ডিনাল গ্রন্থির বিকাশ এবং এর ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ |
|
গোনাডোট্রফিক হরমোন: |
||
ফলিকল উত্তেজক (স্টিমুলেটিং) হরমোন |
ডিম্বাশয়ের ফলিকল-এর বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে |
|
ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ উত্তেজক (স্টিমুলেটিং) হরমোন |
যৌন অঙ্গের বিকাশ ও সেকেন্ডারী যৌন বৈশিষ্ট্য বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে |
|
লিউটোট্রফিক হরমোন |
স্তন গ্রন্থির বিকাশ ও দুগ্ধ সঞ্চরণ নিয়ন্ত্রণ করে। |
|
মধ্যবর্তী অঞ্চল
|
ইন্টারমিডিন বা মেলানোসাইট উত্তেজক (স্টিমুলেটিং) হরমোন |
ত্বকের রং কালো হওয়া নিয়ন্ত্রণ করে |
পশ্চাদবর্তী অঞ্চল
|
অক্সিটোসিন হরমোন |
জরায়ুর সঙ্কোচন করে সন্তান প্রসব সহজতর করে |
ভেসোপ্রেসিন হরমোন |
অনৈচ্ছিক পেশীর সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করে। অধিক পরিমাণে নিঃসৃত হলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় অল্পমাত্রায় নিঃসৃত হলে প্রস্রাবের পরিমাণ হ্রাস পায় |
৭. থাইরয়েড প্রন্থি: শ্বাসনালীর উভয় পাশে হলদে-লাল রং-এর দু’টি পিণ্ড নিয়ে এটি গঠিত।
কাজ: দেহের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের বৃদ্ধি, পরিবর্ধন ও পরিপূর্ণতা নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমায়।
৮. প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি: প্যারাথরমোন রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। মূলত থাইরয়েড গ্রন্থি ও প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির পরস্পর বিরোধী কার্যকারিতায় ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের বিপাক নিয়ন্ত্রণ হয়।
৯. অ্যাড্রেনাল বা সুপ্রারেনাল গ্রন্থি: এটি প্রতিটি বৃক্কের মাথায় টুপির মত একটি করে থাকে। এদের নিঃসৃত কিছু গুরুত্বপূর্ণ হরমোন হল:
· গ্লুকোকর্টিকয়েড: গ্লুকোজ বা শর্করা জাতীয় খাদ্যের বিপাক নিয়ন্ত্রণ
· যৌন হরমোন: অ্যান্ড্রোজেন, এস্ট্রোজন ও প্রজেস্টেরন; এরা সেকেন্ডারী যৌন বৈশিষ্ট্য প্রকাশে ভূমিকা রাখে
· অ্যাড্রেনালিন (বা এপিনেফ্রিন): সঞ্চিত গ্লাইকোজেন থেকে গ্লুকোজ অবমুক্ত করায় ভূমিকা রাখে
১০. থাইমাস গ্রন্থি: এটি “থাইমোসিন” নিঃসরণ করে, যা T (T for Thymosin) কোষ তথা লিম্ফোসাইটের উপর কাজ করে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। (থাইরয়েড-এর সাথে যাতে কনফিউশন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন)
১১. আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান্স: অগ্ন্যাশয়ের বহিঃক্ষরা অংশের কিছু কোষ মিলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আইলেটস বা দ্বীপের মত অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি সৃষ্টি করে। এর বিভিন্ন হরমোন:
· ইনসুলিন: রক্তে শর্করার পরিমাণ হ্রাস পায় (ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন দিলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে)
· গ্লুকাগন: রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি করে
১২. পিনিয়াল গ্রন্থি: এটি হতে মেলাটোনিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা মেলানোফোর বৃদ্ধিতে সহায়ক। (পিটুইটারি গ্রন্থির মধ্যবর্তী অঞ্চল হতে মেলানোসাইট উদ্দীপক হরমোন নিঃসৃত হয়, সেটি আলাদা।)
১৩. শুক্রাশয়ের অন্তঃক্ষরা কলা: এটি হতে টেস্টোস্টেরন এবং সামান্য পরিমাণ ইস্ট্রোজেন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা পুরুষের গৌণ বৈশিষ্ট্যে প্রকাশে সহায়ক।
১৪. ডিম্বাশয়ের অন্তঃক্ষরা কলা: এটি হতে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোন ক্ষরিত হয়। কাজ:
· ইস্ট্রোজেন মহিলার গৌণ বৈশিষ্ট্য বিকাশে সহায়তা করে
· প্রোজেস্টেরন রজঃচক্র পূরণ করার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখে
১৫. এনজাইম হচ্ছে জৈব প্রভাবক যা বিভিন্ন জৈবনিক রাসায়নিক ক্রিয়াকে ত্বরাণ্বিত করে। বহিঃক্ষরা গ্রন্থিতে এনজাইম উৎপন্ন ও নালীর মাধ্যমে ক্রিয়াস্থলে পৌছায়।
১৬. এনজাইমে দু’টি অংশ থাকে, অ্যাপো-এনজাইম এবং কো-এনজাইম। অ্যাপো-এনজাইম নিষ্ক্রিয়, কো-এনজাইম যুক্ত হলে এনজাইমটি সক্রিয় হয়। অ্যাপো-এনজাইম এবং কো-এনজাইম মিলে যে সক্রিয় এনজাইম গঠন করে, একে হলো-এনজাইম বলে।
১৭. যে এনজাইম কোষের ভেতরে কাজ করে, তাকে অন্তঃকোষীয় এনজাইম বলে। (আন্তঃকোষীয় না, আন্তঃকোষীয় বলতে বিভিন্ন কোষের মধ্যে বোঝায়)
১৮. হরমোন সরাসরি রক্ত বা লসিকায় নিঃসৃত হয়ে সেই পথ ধরে ক্রিয়াস্থলে পৌছায়। এটি জৈবিক কার্য-কলাপ নিয়ন্ত্রণের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
১৯. হরমোন ও এনজাইম-এর মধ্যে পার্থক্য:
তুলনীয় বিষয় |
হরমোন |
এনজাইম |
১. উৎপত্তিস্থল |
১. অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি বা নালী বিহীন গ্রন্থি
|
১. বহিঃক্ষরা গ্রন্থি বা নালীযুক্ত গ্রন্থি |
২. রাসায়নিক প্রকৃতি |
২. প্রোটিন বা স্টেরয়েড (কোলেস্টেরলের মত জটিল যৌগ) জাতীয় |
২. প্রোটিন জাতীয় |
৩. উৎপত্তিস্থল হতে ক্রিয়াস্থলের দূরত্ব |
৩. বেশি |
৩. কম |
৪. ক্রিয়া |
৪. নিয়ন্ত্রক পদার্থরূপে
|
৪. প্রভাবক বা অনুঘটক হিসেবে |
২০. কিছু গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের কাজ:
· অ্যান্টিডাই-ইউরেটিক হরমোন (ADH) নেফ্রনের ডিস্টাল বা প্রান্তীয় প্যাঁচানো নালিকা থেকে পানি শোষণ করে পানিসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে।
· অ্যাড্রেনোকর্টিকোট্রফিক হরমোন (ACTH) মেলানিন রঞ্জক সংশ্লেষ নিয়ন্ত্রণ করে গায়ের রং নিয়ন্ত্রণ করে। (যদিও আরেকটি হরমোন রয়েছে “মেলানোসাইট উদ্দীপক হরমোন”।
· অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে ক্ষরিত অ্যালডোস্টেরন Na+ -K+ আয়ন সমতা রক্ষা করে, হৃৎপিণ্ড থেকে ক্ষরিত ANF (অ্যাট্রি ন্যাট্রি ইউরেটিক ফ্যাক্টর) রক্তে Na+ এর পরিমাণ অক্ষুণ্ণ রাখে।